‘আড়াইহাজার’ নামকরণের ইতিহাস

- সফুরউদ্দিন প্রভাত

‘আড়াইহাজার’ নামকরণের ইতিহাস

আড়াইহাজার এর নামকরণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। যার অধিকাংশের কোন দালিলিক প্রমাণ নেই। মাঝে মধ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এসব বিতর্কে না জড়িয়ে আলোর পথযাত্রী পাঠাগার আড়াইহাজার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকবছর গবেষণা চালিয়েছে। চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক জনাব অনুপম হায়াৎ আড়াইহাজার নামকরণের দালিলিক প্রমাণস্বরূপ কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন। কলকাতা থেকে বই সংগ্রহ করে আলোর পথযাত্রী পাঠাগার। সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস বইয়ের আড়াইহাজার এর নামকরণের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। যা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সুবিখ্যাত “আড়াইহাজার” এলাকার নামকরণ প্রসঙ্গে স্বরূপ চন্দ্র রায় লিখিত ‘সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস’ (১৮৯১ খৃঃ) গ্রন্থে যা লেখা রয়েছে:
………সরকার সোনারগাঁ ও পরগণে সোনারগাঁর বহু সংখ্যক মহল লইয়া পুরাকালে উত্তররাম দেব, উত্তরসাহাপুর নামক এক অবান্তর পরগণা স্বনামে এক নম্বরভ‚ক্তে তৎকালীয় গবর্ণমেন্ট হইতে জমীদারী বন্দোবস্থ করিয়া আনেন। ইহার কনিষ্ঠ সহোদর বলরামের নামেও, বলরামপুর বলিয়া অন্য পরগণা চিহ্নিত হয়। আড়াইহাজারের উত্তরবর্ত্তী বলরামপুরে ইহাদের ভদ্রাসন ছিল। উত্তরসাহাপুর, আধুনিক পরগণা নহে। আইন আকবরীতেও ইহার নাম অবিকৃতভাবে উল্লিখিত রহিয়াছে।
এই উত্তররামের পুত্র সন্তান না থাকা প্রযুক্ত, অন্যত আগত যশোমন্ত রায়ের পুত্র গজেন্দ্র, উক্ত দেবের কন্যাকুলসম্ভুত বলিয়া উত্তরসাহাপুর পরগণার অধিপতি হন। ইনিই আড়াইহাজারের চৌধুরীবংশে প্রথম জমীদার।
পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে যে তখনকার গবর্ণমেন্টকে সূত্রানুসূত্রভাবে জমীদারদিগকেও সৈন্যাদি দ্বারা সাহায্য করিতে হইবে বলিয়া প্রতিজ্ঞবদ্ধ থাকিতে হইত। এই গজেন্দ্র চৌধুরী আড়াইহাজার সৈন্য, আদেশ মাত্র উপস্থিত করিবেন বলিয়া আদিষ্ট হন। শাহী সহস্র উপাধির ন্যায় তিনিও “আড়াইহাজারীচৌধুরী” বলিয়া সৈন্যার্থ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সমীপে আহুত হইতেন। গজেন্দ্র, এই গৌরবাত্মক রাজাদেশ চিরস্মরণীয় কর। কর্ত্তব্যবোধে তদুধ্যূষিত সুবিস্তৃত গন্ডগ্রাম, আড়াইহাজার নামে অভিহিত করেন। ইনি অল্প সময়ের মধ্যেই সুনিয়মে রাজস্বাদি আদায় করিয়া রাজভক্ত জমীদারগণের মধ্যে অন্যতম রূপে গৃহীত ও সম্মানিত হন। ইহার জাতি বিশেষে বিদ্বেষ ছিল না। দেশে, বিদেশে তীর্থাদিস্থানে দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, পীরোত্তর, কর্ম্মোত্তর, লাখেরাজ, নান্কার প্রদানে মুক্তহস্ততা প্রদর্শন করেন।
এই চৌধুরীদের অধিকারে মেঘনাদে, বর্তমানে প্রচলিত কুৎ ও জলকর, এই উভয় ধর্ম্মাক্রান্ত “মাশুলেদরিয়াই” বলিয়া এক রূপ কর আদায় হইত। তাহাদের অধিকার দিয়া জলপথে গমনাগমনকারীমাত্রকেই এই কর দিতে হইবে বলিয়া নিয়ম ছিল। পুরাকালে এই পরিবারের এক জামাতা, বিদেশে চাকরী করিতেন, দেশে আসিবার কালে এই মাশুল আদায়ের কর্ম্মচারীগণ কর্ত্তৃক নৌকাধৃত হইলে জামাতা, শ্বশুরের নামোল্লেখ করেন। ইতঃপূর্ব্বে চাদ্দিক হইতে আগত অনেক নৌকা, জামাতার নাম দিয়া নিস্কৃতি লাভ করাতে কর্ম্মচারীগণ প্রকৃত জামাতার সহিত মাসুল না দেওয়ার উদ্দেশ্যে এরূপ পরিচয় দিতেছে ভাবিয়া বচসা আরম্ভ করেন। জামাতাও অকুতোভয়তা এবং তেজস্বীতা দেখাইতে ত্রæটি করেন না। এ উপলক্ষে দুর্দ্দান্ত কর্ম্মচারীদিগের হস্তে জামাতা নিহত হন বলিয়া দেশে প্রসিদ্ধি আছে। [কোনও কোনও চৌধুরী এই ঘটনা অলীক বলিয়া প্রকাশ করেন। জামাতার কোনওরূপ আকষ্মিক মৃত্যু হইলে এই জনশ্রæতির উৎপত্তি হইয়াছে; ইহাই প্রকৃত ঘটনা, নির্নয় করা সহজ নহে। যাহা হোক প্রকৃত ঘটনা হইলেও এতজ্জন্য কোনও
চৌধুরী দায়ী নহেন। অবরোধকারী (?) ভৃত্যই দায়ী।] যৌতুকে প্রাপ্ত দাতাগ্রহীতার নামাঙ্কিত স্বর্ণনির্ম্মিত পান পাত্র দর্শনে জামাতার মৃত্যু অবধারিত হয়। বলা বাহুল্য যে তৎকালে অনেক জমীদার ও জমীদারের ধর্ম্মাজ্ঞান-বিবজ্জিত ভৃত্যগণ, দস্যুতা, বীয্যবত্তা, অত্যাচার পুরস্কার মনে করিতেন।
বহুকাল হইতে এই পরিবার উত্তরসাহাপুরের একাধিপত্য ভোগ করিয়া আসিতেছিলেন। চঞ্চলা ল²ী, কোথাও স্বকীয় বিশেষণের নিরর্থকতা প্রতিপাদন করেন না। ১৮৪০ খৃঃ অব্দ হইতে উত্তরসাহাপুরে কুক্ষণে ভীষণ মোকদ্দমা আরম্ভ হয়। ২৫ বৎসর ব্যাপিয়া আদালত, ফৌজদারী, দাঙ্গা, হাঙ্গামা এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর ১৮৬৫ খৃঃ অব্দে নীলকর জি, পি, শুয়াইজ সাহেবের জয়লাভই, চৌধুরীদের বর্ত্তমান দৌর্ব্বল্যের অন্যতম কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ক্ষীণবল হইলেও পৈতৃক পরগণার উপর গজেন্দ্র পরিবারের অংশত: আধিপত্য অধুনাপি বর্ত্তমান রহিয়াছে। (সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা: ৮৭-৮৯)।

আড়াইহাজার গ্রাম।

আড়াইহাজারে দি বা দিয়া যুক্ত গ্রামের সংখ্যাই বেশি। দি বা দিহি মানে গ্রাম। এ ধরনের নাম আছে ইলমদী, লস্করদী, গহরদী, উদয়দী, দিঘলদী, মহোহরদী, গোপালদী, ডৌকাদি, কল্যান্দী, বল্লভদী, প্রভাকরদী, ধন্দী, শিলমান্দী, ব্রাহ্মন্দী, গোবিন্দী, শ্রীনিবাসদী, লক্ষিবরদী, নরুন্দী, শালমদী বা শাহ আলমদী, দাইরাদী, দলদী, মুকুন্দী, হাইজাদী, আগুয়ান্দী, সিংহদী, কদমদী, সত্যভান্দী সত্যবান্দী, আতাদী, ফৈটাদী, লতবদী, রাঘবদী, রামচন্দ্রদী, বগাদী, বিশনন্দী, সুলতানসাদী, কাহিন্দী। আরো আছে কাদিরদিয়া, দাসিরদিয়া, জোকারদিয়া ইত্যাদি।
মাহমুদপুর ও ফতেপুর ছাড়াও আড়াইহাজার উপজেলায় আছে গাজীপুর, ইসলামপুর, রসূলপুর, শোভারামপুর, রঘুনাথপুর, রায়পুর, গোবিন্দপুর, শম্ভুপুর, মুরাদপুর, আবদুল্লাহপুর, উৎরাপুর, মোহনপুর, মনোহরপুর, সোনাপুর, সিংগারপুর, রংপুর, দাবুরপুর, বাহাদুরপুরাসহ কত উজ্জ্বল ও ঐতিহ্যবাহী ‘পুর’যুক্ত নাম। এসব নামের সাথে জড়িয়ে আছে কত অজানা অকথিত ইতিহাস।
আড়াইহাজারে আছে অনেক কান্দা আর কান্দি। খাগকান্দা, চৈতনকান্দা, দয়াকান্দা, চৌথারকান্দা, হোগলাকান্দা, কান্দাপাড়া প্রভৃতির পাশাপাশি আছে জালাকান্দি, বৈলারকান্দি, চামুরকান্দি, খাসেরকান্দি, ঝাউকান্দি, ইজারকান্দি, ডেঙ্গুরকান্দি, সীতারামকান্দি, লালুরকান্দি, পূর্বকান্দি ইত্যাদি।
সংখ্যাযুক্ত নামও আছে অনেক। আড়াইহাজার থেকেই শুরু। তারপর আছে চব্বিশ খালি, বিশনন্দী, সাতগ্রাম, পাঁচরুখী, পঞ্চবটি ও তিনগাও।
এখানে আছে চরপাড়া, কামরানীরচর, বিনাইরচর, মাঝেরচর, কদমীরচর, ডোমারচর, খালিয়ারচর, মধ্যারচর, বাহেরচর, মোল্লারচর ইত্যাদি।
পাড়ার সংখ্যাও কম নয়। নোয়াপাড়া, বালিয়াপাড়া, কান্দাপাড়া, বাড়ৈপাড়া, দড়িপাড়া, চরপাড়া, ছনপাড়া, তাঁতীপাড়া, কুমারপাড়া, কামারপাড়া, পাটিতাপাড়া, খানপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া, পালপাড়া ইত্যাদি।
নগর নেই কিন্তু নগরযুক্ত নাম আছে-নগরজোয়ার, নগরডৌকাদি, চম্পকনগর, বাঘানগর, আছে ঝাউড়া, কড়ইতলা, শিমূলতলা, ঝাউকান্দি, কাঠালিয়াপাড়া, কদমদী, ছনপাড়া। ব্রহ্মপুত্রের পলিগঠিত এ সমতল ভ‚খন্ডে আছে উজানগোবিন্দী আর আছে ভাটি গোবিন্দী। বালিয়াপাড়ার সাথে আছে ভাটি বালিয়াপাড়া। এখানে আছে রাজঘাট, চৈয়ারঘাট। খালিযুক্ত নাম আছে-উমাখালী, চব্বিশখালী, সোনাখালী, যোগীখালী। আছে টেকপাড়া আর হাজীরটেক। বড় ফাউসার সহোদর আছে ছোট ফাউসা। সত্যভান্দীর সাথে আছে দড়িসত্যভান্দী। ব্যতিক্রমি নাম এখানে দুপতারা বা ধুপতারা। বাজবী, বান্টি, দেবৈ, পুরিন্দা ও গীর্দা। সুন্দর কাব্যিক নাম নয়নাবাদ, জাঙ্গালিয়া। এখানে আছে কাঁচিকাটা খাল, জামাইমারা খাল, নয়নজুলি খাল। আর আছে শান্তির বাজার।

জনবসতি
মোট ৩১৬টি গ্রাম, ১৮৪টি মৌজা, ১০টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উপজেলার জনসংখ্যা, ৩,৭৬,৫৫০ জন, মোট ভোটার সংখ্যা, ২,৫৮,৪৬৩ জন, পুরুষ ভোটার ১,৩১,৬৩৭ জন, মহিলা
ভোটার ১,২৬,৮২৬ জন, ওয়ার্ড, ১০৮টি, মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১১৮টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৯৫টি, বেসরকারি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ০৭টি, বেসরকারি আঃ রেজিঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, ০৩টি, মোট কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি, এনজিও কর্তৃক পরিচালিত প্রাঃ বিঃ, ৪৪টি, মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়, ২৪টি, দাখিল মাদ্রাসা, ০৮টি, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, ০৮টি, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, ১০টি, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, ০৩টি, কওমী মাদ্রাসা (প্রায়), ৫০টি, মক্তব, ৪৬০টি। এ উপজেলায় মুসলমান ৩,৫০,৫৫০ জন, হিন্দু, ২৪,৫১০ জন এবং অন্যান্য ধর্মানুসারী ১৪৯০ জন। শতকরা হিসেবে এ উপজেলায় মুসলিম জনসংখ্যা, ৯৩.০৯৫ ভাগের বেশী। সে বিচারে আড়াইহাজার উপজেলা দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাস্ট্র বাংলাদেশের সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার অন্যতম।

তথ্য সূত্র : প্রামাণ্য গ্রন্থ, আলোকিত আড়াইহাজার

প্রকাশকাল: রবিবার, ১৮ জুন ২০২৩, ০৯:০৩ পিএম   ▪   হালনাগাদ: রবিবার, ১৮ জুন ২০২৩, ০৯:০৮ পিএম   ▪   পঠিত: ৮৪৯



আর্কাইভ