স্মৃতি….
সকালে ঘুমটা খুব গভীর সজীবের। সকালের ক্লাস সে কখনো করে না। রাতের বেলায় ঘুম হয় দুটো তিনটার দিকে। বারোটা পর্যন্ত আড্ডাই চলে। তারপর ঘন্টা দুয়েক পড়াশোনা। তার উপর ইনসমনিয়া। বিছানায় ছুয়ে এপাশ-ওপাশ করে অনেক্ষণ।
কাল রাতেও ঘুম এসেছে তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে। জিতু, সুমন ও রফিক। তিন বন্ধুর সাথে দুটো পর্যন্ত একটানা আড্ড। ওরা উঠে যাওয়ার সময় সজীবকে বলল, “কাল আসবোনা গঞ্জে যাব কাজ আছে”।
জিতু, সুমন আর রফিক সজীবের ছোট্ট বেলার বন্ধু। রাত্রির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তাদের সাথে আড্ডা না দিলে সজীবের ভালো লাগেনা। আর সজীবকেও স্বাভাবিক রাখতে বন্ধুরা তাকে সঙ্গ দেয়ার সবোর্চ্চ চেষ্টা করে থাকে। তারাও ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এখন আর আগের মত সজীবকে সময় দিতে পারেনা।
রাত্রি ছিলো তিন বছরের জুনিয়র। তার চাহনী আর গালে তোল পড়া দেখে অনেক তরুণই এক পলক দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়। ভার্সিটিতে এসে রাত্রিকে দেখে প্রথমদিনই চোখ সরাতে পারেনি সজীব। কিন্তু সে জানতো রাত্রি তার বন্ধু আসিফের বোন। আসিফ ও সজীব একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করে। সে সুবাধে তাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। সজীব দেখতে বেশ হ্যান্ডসাফ। কথাবার্তাও বেশ মার্জিত। মাঝে মধ্যে রাত্রি নিয়ে এক সাথে রিক্সা করে ভার্সিটি যেত সজীব। আসা যাওয়া এক পর্যায়ে দু’জনের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে ছাড়া এক মুহুর্ত অন্য কিছু ভাবতে পারো। এদিকে হঠাৎ করেই আমেরিকার প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায় রাত্রির। ছেলে আমেরিকান সিটিজেন। তাকে নিয়ে চলে যায় আমেরিকা। সজীব কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই এ খবর যেন তার মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত। তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আনার জন্য বাল্যকালের তিন বন্ধু জিতু সুমন রফিক তাকে বুঝনোর চেষ্টা করে। সুমন বলে, ‘ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই সুখ। ভালোবাসলেই বিয়ে করতে হবে এমন কোন কথা নেই। মন দিয়ে পড়াশোনা কর সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বন্ধুর বোন হওয়ায় অনেকটা চেপে যায় সজীব। ভেতরে গভীর দুঃখ কষ্ট থাকলে তা প্রকাশ করেনি।
এদিকে মাস্টার্স পাশ করার পর প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী পেয়ে যায় সজীব। ভালো সেলারী। অফিসে টাইমলি যেতে বেশ সমস্যা হয়। দীর্ঘসময়ের রাতজাগা আর সকালে দেরি করে ঘুম এ অভ্যাস পরিহার করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রতি সকালেই দারোয়ানের টুক টুক শব্দ। তন্দ্রার মধ্যেই সজীব লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে। ফ্রেস হয়ে অফিসে চলে যায়। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকায় এ দু’দিন রাত তিন চারটার পর ঘুমাতে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেও দেড়ি করে।
আজ শুক্রবার বাড়ি লোকজন বেড়াতে যাওয়ায় বাসায় কেউ নেই। ড্রয়িং রুমের সোফায় একা বসে মোবাইলে অনলাইন পত্রিকার খবরগুলো দেখছে। কোন কাজ করতে ভালো লাগছেনা। তাই কিছুক্ষণবাদে টেবিলে বসে ল্যাপটপ চালু করে। কিছু লেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মন সায় দিচ্ছেনা। ইউটিউব চালু করে গান শুনছে-
পৃথিবীর যেখানেই হোকনা কেন
মনে কর, তুমি নেই
সেখানে কোন সুখ নেই
কোন আশা নেই
ভালোবাসা নেই।
ভালোবাসা সবই তোমাকে দিলাম
থাকবো তোমার আমি তোমারই ছিলাম
জোসনা বিলিয়ে চাঁদ হাসতে পারে
তবু তুমিই যদি নাই থাকো
সেখানে কোন সুখ নেই
কোন আশা নেই
ভালোবাসা নেই।
এ গানটি শুনলেই অনেক পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠে সজীবে হৃদয়ের গহীনে। ভাবতে থাকে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কতো আশা-ভালোবাসা গভীরতায় রাত্রিকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলো, আজ সবই স্বপ্নভাঙ্গা এক সাগর কষ্ট নিয়ে দিন কাটাছে।
সজীব ভাবছে, ‘এতগুলো বছর পার হলেও একবারও কি রাত্রির আমার কথা মনে পড়ে না।’ ল্যাপটপে ফেসবুক ঘাটছে আর রাত্রিকে নিয়ে নানান স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে রাত্রি তার বান্ধবী কবিতা নিয়ে গ্রামীণ রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেয়ার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কবিতা রাত্রিকে বলতেছিলো, ‘সজীব ভাইয়ের মত ছেলে পাওয়া আসলে ভাগ্যের ব্যপার, রাত্রি তুই খুব লাকি।’ ওইদিন রাত্রির চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিলো সজীব। রাাত্রি সজীবকে বার বার বলছিলো, ‘তুমি ছাড়া একটি মুহুর্ত কাটে না আমার।’ রাত্রি এই কথাগুলো অশ্রæসিক্ত হয়ে আছে সজীবের কাছে। কিন্তু এসব স্মৃতি এখন সবই অতীত। এ কথা ভাবতে ভাবতে ফের ফেসবুক মেসেঞ্জার ঘাটতে শুরু করে সজীব। মেসেঞ্জার খুলতেই একটি এসএমএস চোখে পড়ে তার। একপলক দৃষ্টিতে এসএমএস এর দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। মেসেঞ্জারে অনেক এসএমএস আসে প্রতিদিন। কিন্তু সেগুলোর প্রতি সজীবের এরকম দৃষ্টি কখনও পড়েনি। কে পাঠলো এসএসএম। সজীবকে একটু চিন্তায় ফেলে দেয়। পরিচিত মনে হচ্ছেনা, আবার অপরিচিত কেউ এভাবে এসএমএস পাঠাতে পারেনা। এসএমএস নিয়ে সজীব লিখতে থাকে-
মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জারে ভেসে আসলো একটি SMS-
কেমন আছো?
বহুবার এ শব্দটির মুখোমুখি হলেও
ওই দিনকার অনুভ‚তিটা একটু ভিন্নই ছিল
হৃদয়টা আচমকা নাড়া দিয়ে ওঠে
ফেসবুক আইডিটাও কেমন যেন অচেনা লাগছে
তবুও কোথায় যেন একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
যাই হোক খুব বেশি ঘাটাঘাটি করতে হয়নি
অল্পতেই আবিস্কার করলাম
এ যে আমার বহুদিনের প্রত্যাশিত ব্যক্তি
রাত্রি, এ তুমি ছাড়া অন্য কেউ নয়!
সময়ের পরিক্রমায় কেটে গেছে অনেকটা সময়
জানতে চেয়েছো….
এ আমি কেমন আছি?
প্রশ্নটা নিতান্তই সহজ কিন্তু উত্তরটা আনুভূতিক
বার বার নিজেকে প্রশ্ন করি
আসলে আমি কেমন আছি?
“ভোরের আলোক ফোটার মুহূর্তে যখন ঘুম ভাঙে
পুব আকাশে উঁকি দেয় সূর্য
হৃদয়ের গহীন থেকে তখন ভেসে আসে
তুুমিহীন একরাশ হাহাকার”
রাত্রি, এখন তুমিই বলো….
আমি কেমন আছি?
প্রকাশকাল: শনিবার, ১০ জুন ২০২৩, ১২:১৮ এএম ▪ হালনাগাদ: বুধবার, ২৬ জুলাই ২০২৩, ০৭:০৩ এএম ▪ পঠিত: ৪৬২