অভিমান
জীবনে কতো কথাই না থাকে। তারই মধ্যে কিছু কথা আছে ভুলাও যায় না আবার বলাও যায় না। মনের আঙিনায় সুযোগ পেলেই যেন উঁকি দিয়ে যায়। প্রায় দেড় যুগ আগের কথা, তখনও ল্যাপটপ সহজ্যলভ্য ছিলো না। তিশা এইচএসসি পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট করায় তার মা তাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দেয়। ল্যাপটপ পেয়ে খুশিতে প্রিয়জনদের মতো দীপকেও এ খবর জানাতে ভুলেনি তিশা।
তিশা দীপকে ফোনে বলে, ‘আমাকে দাওয়াত দিলে ল্যাপটপ নিয়ে আপনার এখানে বেড়াতে আসবো।’
দীপ জানায়, ‘ঠিক আছে অফিসের ব্যস্ততা কমলে তোমাকে আসতে বলবো। তখন তুমি এসো’
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর।
হঠাৎ একদিন তিশার নতুন ল্যাপটপে একটি ডকুমেন্টারি দেখানোর জন্য অফিসে আমন্ত্রণ জানায় দীপ। আমন্ত্রণ পেয়ে এক মুহুর্তও দেরি করেনি তিশা। মনে হয়েছিল দীপের ডাকের জন্যই যেন অপেক্ষায় ছিল সে।
দিনটি ছিলো সোমবার। তিশা যথাসময়ে দীপের অফিসে উপস্থিত হয়। দীপের কলিগরা তিশাকে দেখে একটু উৎসুকসূচক আগ্রহ নিয়ে পরস্পরকে ইঙ্গিত করতে থাকে। বিষয়টি তিশার চোখে ধরা পড়লেও সেদিকে ভ্রæক্ষেপ করলো না।
তিশা তার পরিবারের তিন বোনের মধ্যে মেঝো। দেখতে শ্যামল বরণ হলেও তার কথাবার্তায় যেমন স্মার্টনেস পড়াশোনায়ও অত্যন্ত মেধাবী।
অপরদিকে দীপ চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। সে বেসরকারি একটি কোম্পানীতে মার্কেটিংয়ে চাকুরি করতো। বসের সাথে বনিবনা না হওয়াতে চাকুরিটি ছেড়ে দেয়। এখন সে প্রায় বেকার জীবনযাপন করছে। জমানো টাকা শেষ হতে চলল। আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে এ ভাবনায় তার জীবন অস্থির। ইতোমধ্যে নবপ্রতিষ্ঠিত কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করার জন্য অফার আসে। বেতন কম হলেও হাত খরচ চালানোর জন্য শিক্ষকতার এক নতুন অভিজ্ঞতা শুরু হয় তার। দীপের ক্লাস নেয়ার ধরণ দেখে অল্প সময়ে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। শিক্ষকতা শুরু করার মাস খানেকের মধ্যে একটি টিউশনির অফার আসে। একাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে পড়াতে হবে। ফেমিলিটি বেশ স্বচ্ছল। তাই কলেজ সময় পার হওয়ার পর হাতে বেশ সময় থাকায় টিউশনি করতে রাজি হয় দীপ। প্রথম দিন পড়াতে গিয়ে দীপের বুঝতে বাকি রইলোনা যে তার ছাত্রীটি যথেষ্ট মেধাবী। দীপ তাকে ইন্টারমিডিয়েটের ফাইনাল পর্যন্ত বছর দুয়েক বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়েছে। তার মেধার তারিফ সবসময় সহকর্মীদের শোনাতো। অতি অল্প সময়েই তার যেকান বিষয় দ্রæত আয়ত্ব হতো, তা দেখে শ্রেণি শিক্ষকরা তিশার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী। তাকে ঠিকমত পরিচর্যা করলে একদিন সে অনেক ভালো কিছু করে দেখাতে সক্ষম হবে। কলেজে শিক্ষকতা করা অবস্থায় ভালো বেতনের একটি চাকুরি হয়ে যায় দীপের। চাকুরি পাওয়ার পর দীপ গ্রামের বাড়ি সৈয়দপুর থেকে রংপুর শহরে চলে আসে। তিশার সাথে দেখা হয় না অনেক দিন।
দীপের আমন্ত্রণে তিশা এই প্রথম তার অফিসে এসেছে। অনেক দিন পর দেখা হওয়াতে তিশা অস্থিরমুক্ত কিছুটা ভাবপ্রবণতা পরিলক্ষিত হলেও তা অন্যদের চোখে তেমন পড়েনি। ডকুমেন্টারি প্রদর্শন শেষে দীপ ও তার কলিগদের সাথে তিশাও লাঞ্চ করে। পরে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয় তিশা।
মেয়েটি কে?
দীপের সহকর্মী লাবণ্য জিজ্ঞেস করে।
-মেয়েটির নাম তিশা। পুরো নাম নাঈমা রহমান তিশা। বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
‘দেখতে অত্যন্ত চমৎকার। কথাবার্তা আচার আচরণ আমাদের মুগ্ধ করেছে’
লাব্যন্যের এ কথার সাথে অন্য সহকর্মীরাও সুর মেলাচ্ছে।
কিন্তু সহকর্মীদের মুখে তিশার এত প্রশংসা শুনে কেমন যেন সন্দেহ লাগছে দীপের।
‘আপনারা তিশার এত প্রশংসা করার মানে জানতে পারি?’ জিজ্ঞেস করে দীপ।
দীপের প্রশ্নের প্রতিত্তরে লাবণ্য বলে-
-অভয় দিলে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই?
বলেন, কি বলতে চান?
আপনি বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছেন। আমাদের মনে হয় তিশার চেয়ে পারফেক্ট মেয়ে হয়না। তিশার চাহনিতে বুঝার চেষ্টা করেছি, তিশা আপনাকে অনেক পছন্দ করে। লাবণ্যের কাছ থেকে এ কথা গুনে অবাক হয়ে যায় দীপ। সে বেশ কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে থাকে। কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। তিশাকে বিয়ে, এ যেন কখনও কল্পনাতেও আসেনি দীপের।
লাবণ্যের সাথে অন্য কলিগরাও বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য তার উপর এক প্রকার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।
‘আপনি না পারলে সবার পক্ষ থেকে আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব’ লাবণ্য’র জোরালো আবদার।
একথা শোনার পর দীপ তার অফিস রুমে চলে যায়। রুমের দরজা বন্ধ করে একান্তেই ভাবতে থাকে। ঘন্টা খানেক পর রুম থেকে বেড়িয়ে কলিগদের সাথে বসে।
লাবণ্যর একটাই কথা, ‘ আমিই তিশাকে বিয়ের প্রস্তাব দিব। আপনি না করতে পারবে না।’
-‘না আপনার দিতে হবেনা, আমি নিজেই তাকে প্রস্তাব দিব’ একথা লাবণ্যকে জানায় দীপ।
তিশা এবং দীপ দু’জনেই পাশাপাশি গ্রামের। দু’জনের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটিও এক। রংপুর শহর থেকে তাদের গ্রামের বাড়ির পাশে সৈয়দপুরপুর বাসস্ট্যান্ডের দুরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার।
তিশাকে ফোন করে দীপ। ‘তুমি বাড়ি যাওয়া সময় আমাকে সাথে নিয়ে যেও, জরুরি কিছু কথা বলার আছে।’
তিশা তার কথা সায় দেয়।
শুক্রবার বন্ধ থাকায় প্রতি বৃহস্পতিবার দু’জনেই গ্রামের বাড়িতে যায়। শনিবার সকালে রংপুরে ফিরে আসে। বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অফিসের গেইট থেকে রিকসায় ওঠে দীপ।
রিকসাওয়ালা জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন স্যার’
দীপ: বাসস্ট্যান্ডে যাও ভাই।
রিকসায় বসে তিশার কথা ভাবছে দীপ। কিভাবে বিয়ের প্রস্তাবটি তিশাকে দিবে। বললেই বিষয়টি কিভাবে নেবে। এ কথা চিন্তা করতে করতে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে দীপ। রিকসা থেকে নেমে দু’জনের জন্য বাসের টিকিট কেটে তিশার জন্য অপেক্ষা করে দীপ। এর মিনিট দশেকের মধ্যে তিশা রিকসা থেকে নেমে দীপের কাছে চলে আসে।
বাসের ওঠে পাশাপাশি সিটে বসে দু’জনে। বাস গন্তব্যের উদ্দেশ্যে স্ট্যান্ড ছেড়ে চলতে থাকে।
বাসের ঝাকুনি দীপের মনের ভিতর যেন কাঁপন ধরাচ্ছে। বিয়ের বিষয়টি কিভাবে বলবে তা ভেবে পাচ্ছেনা দীপ, এক ধরনের অস্থিরতা শরীর থেকে ঘাম নির্গত হচ্ছে। এদিকে তিশা বার বার তাকে জিজ্ঞেস করছে ‘আপনার কি জানি জরুরী কথা আছে ? বলেন-
এরই মধ্যে সহকর্মী লাবণ্য দীপের মোবাইলে ফোন করে,
-জানতে চায়
‘স্যার আপনি কি তিশাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন?’
দীপ : ‘না বলিনি, …এখনই বলবো।’
আধা ঘন্টা বাস চলার পর এক পর্যায়ে দীপ তিশাকে জানায়, ‘আমার সহকর্মীরা তোমাকে বেশ পছন্দ করেছে। তারা তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছে। তুমি যদি এ প্রস্তাবে রাজি থাক তাহলে বিষয়টি সামনে নিয়ে যাব। আপত্তি থাকলে এখানে শেষ, আমাকে ভুল বুঝনা।’
পরের বার দম নেয়ার আগেই কথাগুলো একটানে….তিশাকে বলে শেষ করে দীপ।
এ কথা শোনার পর তিশা একেবারে চুপছে যায়। মিনিটি দশেক পর তিশা বলে ‘আমি এ প্রস্তাবে রাজি। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আম্মার ওপর। আম্মা যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে পরিবারের আর কারও সম্মতি লাগবেনা।
তোমার আম্মাকে কে বলবে? জিজ্ঞেস করে দীপ।
‘আম্মাকে আমিই বলবো। আশা করি তিনি এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন না’ এ কথা দীপকে জানিয়ে সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে দু’জনেই যে যার মত বাড়ি চলে যায়।
এরপর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যায়। তিশার কোন যোগাযোগ নেই। মাস খানেক পর ফোন করে দীপ। তিশার কাছ থেকে তার আম্মার সম্মতির বিষয়টি জানতে চায়। পরে জানাবো বলে তিশা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কয়েকদির পর সহকর্মী লাবণ্য দীপের কাছ থেকে তিশার মোবাইল নাম্বার নেয়। তিশার মোবাইলে কল করে লাবণ্য। ফোনে তিশা লাবণ্যকে জানায় তার আম্মা এ বিয়েতে সম্মতি এখনও দেইনি।
লাবণ্য’র কাছ থেকে এ কথা শুনে পিছু হটে দীপ। তিশার সাথে বিয়ের বিষয়টি নিয়ে দীপ আর ভাবতে রাজি নয়। তিশার প্রসঙ্গ তুলতে কলিগদেরও সে নিষেধ করে। তবে এ ঘটনার পর তিশার মায়ের অসম্মতি বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে দীপের। কিন্তু তার ভেতরের চাপা কষ্ট কলিগদের বুঝতে দেয়নি। বরং কলিগদের কাজের মন দেয়ার তাগিদ দিয়ে নিজে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। এরপর তিশার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় দীপের।
বছর খানের পর দীপ তার মা-বার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। বেশ সুন্দরভাবে দীপের দাম্পত্য জীবন কাটছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে দশ বছর। তিশার সাথে যোগাযোগ নেই।
দীর্ঘ সময়ের পর তিশার এক বান্ধবীর কাছ থেকে দীপ জানতে পারে তিশা একটি বেসরকারি ফার্মে ভালো পোস্টে চাকুরী করে। এর মধ্যে তিশার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এর কয়েক বছর পর ছোট বোনও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বেশ সুখেই জীবন-যাপন করছে। কিন্তু তিশার এখনও বিয়ে হয়নি।
কিন্তু দীপের কাছে বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক মনে হয়। তিশা নিজেকে কেন এভাবে লুকিয়ে রেখেছে। তার কলেজ পড়–য়া বান্ধবী সকলেই ঘরসংসার ও ছেলে মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই জীবন কাটাচ্ছে।
তিশার ক্ষেত্রে এমন হওয়ার তো কথা নয়। একজন মেধাবী স্মার্ট মেয়ে কি কারণে বিয়ের পিড়িতে বসছেনা। সে কি তাহলে কোন ক্ষোভের কারণে বিয়ে করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নানা প্রশ্ন দীপকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। এ ভাবনা দীপ রাতে ঘুমাতেও পাচ্ছেনা।
‘আমার সাথে তিশার তো প্রেমঘটিত কোন ব্যপার ছিলো না তবে কেনইবা এমনটা হলো। আমাকে যদি সে একবারও বলতো, ‘আমার জন্য অপেক্ষা করেন, তাহলে না হয় অপেক্ষা করতাম। একথাও তিশা কোনোদিন আমাকে বলেনি। তাহলে কিসের এত অভিমান’-দীপকে এ কথাগুলো ভাবনায় ফেলে দেয়।
এদিকে তিশার এক কাজিনের নিকট দীপ জানতে পারে যে, দীপের সাথে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়াতেই অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে বিয়ে করতে ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে উঠে তিশা। এ খবরটি জানার পর দীপ বুকের ভেতর নিদারুন কষ্ট অনুভব করে। বার বার তিশার স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভেসে আসতে থাকে।
রাতের নিস্তব্ধতায় নিজের অজান্তেই তিশাকে যতবারই মনে পড়ছে, দীপ ততবারই নিজের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে……
অভিমান ভাঙবো কেমন করে!
তার উত্তর পাইনি খোঁজে
ব্যথার আঁকড়ে ডুবে থাকা কষ্টগুলো
পরম যতনে রেখে যাও আড়াল করে
শত চেষ্টায়ও তা বুঝতে দাওনা আমায়
কি এমন অভিমান যা শুধু তোমার?
প্রকাশকাল: বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩, ০৮:১৮ পিএম ▪ হালনাগাদ: বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩, ০৮:১৮ পিএম ▪ পঠিত: ৪২৬